18 May 2024, 03:13 pm

বিলুপ্তির পথে মুক্ত জলাশয়ের দেশীয় প্রজাতির মাছ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

এম কবীর, ঝিনাইদহ : খাদ্যভাস্যের তালিকায় মাছ একটি নিত্য খাবার যা আমিশের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থান দখল করলেও বর্তমানে মাছে আগের দিনের সেই স্বাদ আর নেই।  মাছ চাষে ফিড খাওয়ানোর কারণে থাকছে না প্রকৃত স্বাদ ও গন্ধ। পোনা উৎপাদন থেকে শুরু থেকে চলছে কৃত্তিম খাবার ভাসমান ডুবো লেয়ার গোয়ারের পাল্লাপাল্লি । কথায় আছে মাছের পোনা, দেশের সোনা। আর দেশি মাছ পুষ্টির আঁধার। দেশি এ মাছগুলোতে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন। তাছাড়া দেশি মাছের আছে অন্ধত্ব, রক্তশূন্যতা, গলগন্ড প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ছোট ছোট মাছ খাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। দেশি মাছের এসব পুষ্টিগুণ আমিষের নিরাপত্তা গড়ে তুলতে মানব শরীরে অপরিহার্য।

নদি-নালা, খাল, বিল, হাওড়-বাওড় শুকিয়ে মুক্ত জলাশয়ের মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে এবং ফসলী জমিতে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োগের কারনে মাছের জীবনচক্র আজ বিপদগ্রস্থ। কৃত্রিম উপায়ে ঘের-পুকুরে মাছের চাষ বৃদ্ধি পেলেও প্রকৃত স্বাদ বিনষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গ্রাম-গঞ্জের খালে বিলে কিছু দেশী মাছ মিললেও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল্য।

সরোজমিনে ঝিনাইদহের মাছ বাজারে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির চাষের মাছ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিদেশী রুই, কাতলা, চিতল, কৈ, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস এবং কার্প প্রজাতির মাছের যোগানই বেশী। দেশী মাছ খোঁজ করলে কয়েকজন জন মৎস্যজীবি অল্পসংখ্যক মাছ ডালিতে নিয়ে বসে আছে। আর যে দাম চাচ্ছেন তা নিম্নবৃত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। বিক্রেতার দাবি এসকল ছোট মাছ এখন পাওয়াই যায় না। সারাদিন মাছ ধরে করে সংসার চালানো কষ্ট সাধ্য ব্যাপার। মাছ বিক্রেতা তৈলকূপী গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস বলেন, বাজারে দেশী মাছের চাহিদা থাকলেও এই ধরনের ঝিয়া, পুটি, ট্যাংরা, খলিষা, শিং, রইনা, কাকীলা, বাইম, পাকাল, গচি, গরগতে, চিংড়ী, চ্যাং, দেশী মাগুর, পাবদাসহ এ জাতিয় মিঠা পানির মাছের দেখা মেলাই ভার।

বাজারে আসা মাছের ক্রেতা আব্বাস মিয়া জানান, চাষের মাছে বাজার দখল করলেও ভোক্তারা বাজার করতে এসে আগে খোঁজ করেন ছোট জাতের দেশী মাছ। কেননা চাষের দেশী-বিদেশী মাছগুলোতে থাকেনা মাছের প্রকৃত স্বাদ ও গন্ধ। মৎস চাষি পরিতোষ মালো জানান, চাষের মাছের ফলন বেশী হলেও ব্যবসা সফল হতে পারছে না সাধারন মৎস্য চাষীরা। স্থানীয় বাজারে মৎস্য ব্যাপারীদের কাছে পাইকারি মূল্যে অল্প টাকায় বিক্রয় করতে হচ্ছে এসব মাছ। অপরদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে মাছের খাদ্যের দাম। উৎপাদন খরচের সাথে চাষের মাছের বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় সঠিক মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মাছ চাষিরা।

ভূক্তভোগীরা জানান দেশি মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে আগে প্রাকৃতিক জলাশয়, মাছ সংরক্ষণ এবং মৎস্য পরিবেশবান্ধব নীতি ও অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। আর বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে ১২টি চরম বিপন্ন এবং ১৪টি সংকটাপন্ন। যদিও চিংড়িসহ ২৯৬টি মিঠাপানির মাছ এবং ৫১১টি সামুদ্রিক মাছ রয়েছে। এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে মাছের যে প্রাকৃতিক জলাশয়, মুক্ত জলাশয় রয়েছে তা আমাদের অযাচিত ও অনৈতিক ব্যবহারের কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বংশবিস্তারকে হুমকির সম্মুখীন করছে। মাছের জাটকা সংরক্ষণে সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং মৎস্য অধিদপ্তর বেশ প্রচার প্রচারণা করছে কিন্তু সে বিষয়টি এখনও সাড়া জাগানো সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা সম্ভব হয়নি। দেশিয় মাছ অবশ্যই সংরক্ষণ মুক্ত জলাশয়ে তার অবাধে বিচরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থান ও আমিশের ঘাটতি পুরন করা সম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন মৎস্যবান্ধব পরিবেশনীতি ও অবকাঠামোর সফল বাস্তবায়ন।

এ ব্যপারে মৎস্য কর্মকর্তাদের বক্তব্য, দেশি মাছগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায় সেজন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। সেগুলো হলো ধান ক্ষেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারা বছর পাওয়ার জন্য ধানক্ষেতে মিনি পুকুর তৈরি, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য বিষ প্রয়োগ না করা, রুই জাতীয় মাছের সাথে  পছাট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয় এবং পুকুরে দেশি মাছের চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

যদিও বর্তমানে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষেত্র, চলাচল অনেকখানি হুমকির মুখে। আমরা না জেনে, না বুঝে জাটকা নিধন করি। তাছাড়া জমিতে অতি মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ দেয়া, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা থেকে বিরত না থাকার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না।

একটা সময় গ্রামঞ্চালে বর্ষা মওসুমে দেশীয় মাছ ধরার উৎসব ছিল। বর্ষার নতুন পানিতে পাওয়া যেত বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ। চৈত্র, বৈশাখ এবং আষাঢ় মাসে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছের ডিম, রেনু ও পোনা দেয়। অভিজ্ঞ মহলের মতে দেশি মাছ সংরক্ষণের জন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করা, মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, পুরাতন জলাশয়গুলো সংস্কার করা, ছোট দেশি জাতের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় সংরক্ষণ করে মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য উপযোগী করে দেশীয় মাছের সংরক্ষন রাখা অতিব প্রয়োজন। সাধারন মানুষের দাবি, জলাশয় খাল, পুকুর ভরাটের কারণে মাছের আবাসস্থল নেই যার কারনে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির সু-স্বাদু মাছ।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 4678
  • Total Visits: 744145
  • Total Visitors: 2
  • Total Countries: 1126

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ ইং
  • ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
  • ৯ই জ্বিলকদ, ১৪৪৫ হিজরী
  • এখন সময়, বিকাল ৩:১৩

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
20212223242526
2728293031  
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018